হালিশহরের সিদ্ধেশ্বরী কালী শুধু কোনো সাধারণ কালীমুর্তি নয়। এর সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে রয়েছে সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক বিচিত্র অধ্যায়।
সাধকরা বলেন, গঙ্গার পূর্বকুল বারানসী সমতুল।সেই প্রবাহমান পতিতপাবনী গঙ্গার তীরেই মায়ের মন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দিরের ইতিহাসের সাথেই জড়িয়ে আছে হালিশহর, কাঁচরাপাড়া, নৈহাটি ও বৈদ্যবাটির জন্মবৃত্তান্তের অনেক অজানা কথা।
সাবর্ণ গোত্রীয় পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সম্রাট হুমায়ুনের সেনাপতি। সম্রাট তাঁর কর্মদক্ষতায় খুসি হয়ে সম্রাট হুমায়ুন তাঁকে ‘সখত্ খাঁ’ বা ‘শক্তি খাঁন’ উপাধি দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তাঁকে ৪৫টি গ্রাম বা পরগণার জায়গির প্রদান করেন বলে কথিত। সাবর্ণ বংশধরেরা একসময় ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে ত্রিবেনীতে থাকতেন। সেনাবাহিনী থেকে অবসরগ্রহণের পর পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়ই প্রথম গঙ্গার পূর্বতীরের হালিশহর, কাঁচরাপাড়া, নৈহাটি প্রভৃতি অঞ্চলে বসতি গড়ে তোলেন। সেকারণে তিনিই প্রথম এই অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য সমাজের পত্তন করেছিলেন।
তিনিই পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর থেকে বৈদ্যদের নিয়ে আসেন এবং তাঁদের জন্য হালিশহরে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বৈদ্যদের মধ্যে কয়েকজন আবার ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে বসতি গড়েন। বর্তমানে সেই জায়গাটির নাম “বৈদ্যবাটী”। ওড়িশা এবং দক্ষিণভারত থেকে যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণদের এনে চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন ভট্টপল্লীতে। সেখানে তাঁদের থাকার জন্য জমি দান করলেন। বর্তমানে সেই জায়গার নাম “ভাটপাড়া”। সেখানে কালে কালে অনেকগুলি চতুষ্পাঠী ও টোল স্থাপিত হয় মূলত তাঁরই অনুপ্রেরনায়। টোল ও চতুষ্পাঠীতে বহু কুমারবয়সি ছাত্রদের আগমন ঘটে, দিনের বেলায় এই স্থানগুলিকে দেখে মনে হত যেন কুমারদের হাট বসেছে। এইভাবেই অঞ্চলের নাম হয়ে যায় কুমারহট্ট হালিশহর।পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় স্বর্ণশিল্পীদেরও এখানে এনেছিলেন, সেই জায়গাটির নাম “কাঞ্চনপল্লী” হয়ে যায়। বর্তমানে সেই জায়গাটি কাঁচড়াপাড়া নামে প্রসিদ্ধ। শিল্পীদের বিভিন্ন শিল্পসামগ্রী বিক্রি করবার জন্য নতুন করে হাট বসানোর ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন, অতীতে সেই হাটের নাম ছিল “নবহট্ট”। অতীতের সেই “নবহট্ট” বর্তমানে “নৈহাটী” নামে পরিচিত। সুতরাং সাবর্ণ বংশের পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় সৃজনশীল বংশধরগণের অন্যতম ছিলেন।
এই বংশের ২৫তম বংশপুরুষ বিদ্যাধর রায় চৌধুরী(১৬৪০-১৭২০) হালিশহরে বহু কর্মনিদর্শন রেখে গেছেন। তিনিই কুমারহট্ট হাভেলিশহরে শাক্ত-শৈব এবং বৈষ্ণব এই তিনধারার সুবন্ধন স্থাপন করে গিয়েছিলেন।
কথিত রয়েছে রায় বিদ্যাধর মজুমদার চৌধুরী আজ থেকে প্রায় শোয়া তিনশো বছর আগে সকালে গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে একটি কষ্টিপাথর পেয়েছিলেন।এই কালীমূর্তি প্রাপ্তি সম্বন্ধে একটি কাহিনি এই অঞ্চলে প্রচলিত আছে। কালী সাধক বিদ্যাধর রায় প্রত্যহ ব্রাহ্ম-মুহূর্তে গঙ্গায় স্নান করতে যেতেন। গঙ্গা স্নানের সময় তিনি প্রত্যহ উদাত্ত কণ্ঠে গায়ত্রী মন্ত্র ও কালীস্তব করতেন। এমনি একদিন গায়ত্রী মন্ত্র কালীস্তব শেষ করে জাহ্নবীর পবিত্র জলে স্নান করতে গিয়ে একটি শিলাখণ্ড পেলেন। তিনি সেই শিলাখণ্ডের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ না দেখিয়ে বরং মনে মনে মায়ের নাম কীর্তন করতে করতে বাড়ি ফিরে আসেন। হয়তো সেই শিলার কথা কোনদিন তাঁর মনেও পড়ত না কিন্তু একদিন স্বপ্নে দর্শন দিয়ে দেবী সিদ্ধেশ্বরী তাঁকে বললেন, বিদ্যাধর! গঙ্গার ওই পাথর দিয়ে আমার মূর্তি গড়ে বলিদাঘাটায় গঙ্গার তীরে যেখানে বিশ্বনাথ রয়েছেন তাঁর পাশে আমায় প্রতিষ্ঠা কর।পরদিন সকালে এক অন্ধ ভাস্কর চৌধুরী বাড়িতে এসে বিদ্যাধর রায়কে বলেন, গঙ্গা থেকে সেই পাথরটি তুলে আনুন, আমি সিদ্ধেশ্বরীর মূর্তি গড়ে দেবো। বিদ্যাধর বুঝলেন সবই ইচ্ছাময়ী জগজ্জননীর কৃপা। তখন তাড়াতাড়ি জাহ্নবীর পুণ্য সলিল থেকে প্রস্তরখণ্ডটি তুলে আনলেন। সেই কষ্টিপাথর থেকে এক অলৌকিক দ্যুতি বেরোতে থাকল। শিল্পী তাঁর ধ্যানলব্ধ মাতৃমূর্তি পাথরে খোদিত করে দু ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট চতুর্ভুজা এক অপূর্ব দেবী মূর্তি তৈরি করলেন। শোনা যায় মূর্তি গড়ার পর কিছু শিলাখণ্ড অবশিষ্ট থাকায় তা দিয়ে সেই ভাস্কর একটি শিব ও কৃষ্ণমূর্তি গড়েছিলেন। নাম দিলেন বুড়ো শিব ও শ্যামরায়। সেই তিনটি মূর্তিই হালিশহরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাজারপাড়ার গঙ্গাতীরে সিদ্ধেশ্বরী, চৌধুরীপাড়ায় শ্যামরায় এবং শিবের গলিতে বুড়োশিব প্রতিষ্ঠা করেন। বাজারপাড়ার তিনশো বছরের পুরানো মন্দিরটি ধ্বংস হয়ে গেলে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মন্দিরটি স্থানান্তরিত হয় বলিদাঘাটায়।
সেই থেকেই কালিকাদেবীর নামানুসারে বাজারপাড়ার নাম হয় কালিকাতলা। পরবর্তীকালে ১৩২৩ বঙ্গাব্দে সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশজ যোগেশচন্দ্র রায় চৌধুরীর স্ত্রী বসন্তকুমারী দেবী সিদ্ধেশ্বরী মন্দির ও তার সামনের নাটমন্দির সংস্কার করেন।বর্তমানের নবনির্মিত মন্দিরটির নির্মাণকাল ৮ই আগস্ট ১৯৯৮ সাল। মন্দিরের সামনে রয়েছে দক্ষিণদিকে একটি নাটমন্দির। কড়িবরগার ছাদ এবং বারোটি থাম রয়েছে নাটমন্দিরটিতে। সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের পাশেই রয়েছে আটচালার শিবমন্দির।
অমূল্য কষ্টিপাথরের চতুর্ভূজা সিদ্ধেশ্বরীমাতার অপূর্ব বিগ্রহ রয়েছে মন্দিরের গর্ভগৃহে। হাতে খড়্গ, নৃমুণ্ডমালিনী, লোলরসনা, বরাভয় আর অভয়দান করছেন দেবী। দেবীর বাম পদ শ্বেত পাথরের মহাদেবের হৃদয়ের উপর দণ্ডায়মানা।পরবর্তীকালে বলদেঘাটার চট্টোপাধ্যায় পরিবারকে সাবর্ণরা দেবত্তর সম্পত্তি দানপত্র করেছিলেন দেবীর সেবা ও ব্যয়ভার বহনের জন্য। ১৯৬৪ সালে মায়ের মূর্তিটি চুরি হয়ে যায় এবং পায়ের পাতাটি ভেঙে যায়। ঐ ভাঙা পা নিত্য সেবা হয় এখনও। এরপর ১৯৯৮ সালে মায়ের বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। রাখিপূর্ণিমার দিন এই মন্দিরের বাৎসরিক উৎসব হয়। বহু ভক্তসমাগম ঘটে এদিন মন্দিরে। বাৎসরিক উৎসবের দিন সকাল থেকে মায়ের বিশেষ পূজা হয়, সেদিন মা সিদ্ধেশ্বরীকে বেনারসি শাড়ি এবং বিভিন্ন গহনা দিয়ে সাজানো হয়। সোনার গহনার সাথে গোলাপ ফুলের, পদ্মের, জবা, বেল পাতা, নীলকন্ঠের ইত্যাদি ফুলের মালার পরানো হয়।এইভাবে আজও প্রাচীন ও হালিশহরের ঐতিহ্যপূর্ণ মন্দিরে মা সিদ্ধেশ্বরীর নিত্যসেবা হয়ে চলেছে।
0 Comments